NotesWhat is notes.io?

Notes brand slogan

Notes - notes.io

জাহানারা হকের খুলনায় একটা একতলা বাড়ি ছিল। সামনে ছোট্ট উঠোন, উঠোনের শেষ মাথায় একটা ক্যামেলিয়া ফুলের গাছ। তাঁর নিচে একটা টি টেবিল। জাহানারা হকের ডাক নাম লিলি। একদিন এক মেলা থেকে ফেরার পথে শখ করে তিনি একটা লিলি গাছের চারা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। গাছটা বড় হবার পর টের পাওয়া গেলো সেটা লিলি না, ক্যামেলিয়া। জাহানারা হক ইকবাল নগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। সময়টা ১৯৬৬ সাল। জাহানারা হকের স্বামী খন্দকার জহুরুল হক খালিশপুর সোনালি ব্যাংকের এসিস্টেন্ট ম্যানেজার। প্রতিদিন দুপুরের দিকে জাহানারা হক স্কুল থেকে বাড়ি ফেরেন, এক কাপ চা নিয়ে ক্যামেলিয়া গাছের তলায় বসেন। একটু পড়েই তাঁর বড় ছেলে খোকন স্কুল থেকে ফেরে। বাংলা ভাষায় আদর্শ ছেলে বলে একটা শব্দ আছে যেটা সম্ভবত খোকনের জন্য তৈরি হয়েছে। পড়াশোনায় খুব ভালো। বাবা মা'র দিকেও খোকনের খুব খেয়াল। জাহানার হকের ছোট ছেলের নাম শাহিন। শাহিন খুব দুরন্ত, সারাদিন ফুটবল খেলে। পৃথিবীর কোন কিছুতে তাঁর ভয় নাই। শুধু তাঁর বাবার সামনে দাঁড়ালে তাঁর সব সাহস বাষ্প হয়ে আকাশে উড়ে যায়। জহুরুল হক প্রচন্ড পেটাতে পারেন। খুব রাশভারী, গম্ভীর এবং ভয়ংকর সৎ এই লোকটার ভেতরে কেউ ঢুকতে পারে না, শুধু তাঁর ছোট্ট মেয়ে তুহিনের জন্য তাঁর সব রাগ জল হয়ে যায়। বাসার গেট থেকে " আমার বুড়ি কই, আমার বুড়ি ... " বলতে বলতে জহুরুল হক বাসায় ঢোকেন। ছোট্ট তুহিন দৌড়ে আব্বা আব্বা বলে কোলে ঝাপিয়ে পড়ে। খোকন তখন হয়তো ঘরে বসে অংক করে, শাহিন কই কি করে কেউ জানে না। জাহানারা হক ক্যামেলিয়া গাছ তলার টি টেবিলে চা কাপে স্বামীর জন্য চা ঢালতে ঢালতে নিজের বাড়িটার দিকে তাকান। আহা কি সুন্দর সংসার তাঁর ! তাঁর তো আর কিছু চাওয়ার নেই।
১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে কোন এক সন্ধ্যায় খন্দকার জহুরুল হক তাঁর ব্যাংকের পাকিস্তানি ম্যানেজারের সাথে ঝামেলা করে চাকরী ছেড়ে বাসায় চলে আসলেন।
-- তুমি এটা কি করলে? কি করলে তুমি এটা?
-- আহ লিলি, বেশি বুইঝো না, এই চাকরী করা সম্ভব না আমার পক্ষে।
-- এখন এই তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে আমি চলব কিভাবে? এই সংসার চলবে কিভাবে?
-- আরে মরে তো যাই নি, একটা কিছু হবে। আমি তো আছি।
খন্দকার সাহেব ছিলেন কিন্তু কিছু করতে পারলেন না। এক বছরে তাঁর কোন চাকরী হল না। তখন খুব খারাপ সময়, দেশের কোথাও কারো চাকরী নাই। অবশেষে চাকরী হল, তবে খন্দকার সাহেবের না, উনার স্ত্রী জাহানারা হকের। ১৯৬৯ সালে জাহানারা হক পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ে একটা চাকরী পেলেন। পোস্টিং খুলনাতেই। কিন্তু শেষ ১ বছর নিজ সংসার আর গ্রামে বাবা মা'র দেখাশোনা করতে গিয়ে খন্দকার সাহেব অনেক ঋণ করে ফেলেছেন। এই কথা উনি উনার স্ত্রীকে বলেন নাই। উনার আসলে বলার সাহস হয় নাই। পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে ১৯৭০ সালের জানুয়ারী মাসে বিশ্বের ১৭ টা দেশে ট্রেনিং এর জন্য জাহানারা হক বিদেশ গেলেন। ৪ মাস পর স্বামীর জন্য শিকাগোর নাইকনের ফ্যাক্টরী থেকে একটা ক্যামেরা নিয়ে দেশে ফেরার পর জাহানারা হক জানতে পারলেন তাঁর স্বামী খুলনার ইকবাল নগরের শখের বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে যশোরে ছোট্ট একটা বাড়ি করেছেন। বাড়ির সামনে একটা পুকুর। পুকুর ভরা কচুরিপানা। দূরে রেল লাইন। একটু পর পর ধোঁয়া তুলে ট্রেন আসে যায়। ঠিক যেন পথের প্যাচালি থেকে তুলে এনে বসানো কোন দৃশ্য।
এ দেশের মানুষের জন্য মুক্তিযুদ্ধ খুব বড় একটা বিপর্যয় ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের দেশের মানুষের ব্যাক্তিগত দুঃখ, কস্ট, বেদনা, কান্না সব মুছে দিতে পেরেছিল। মানুষ তখন এসবের চেয়ে অনেক বড় এবং ভয়ংকর পরিনতির জন্য অপেক্ষা করছে। জাহানারা হকের খুলনার বাড়ি তাঁকে খুব বেশিদিন দুঃখ দিতে পারলো না। ৭১ সালের মার্চে খন্দকার সাহেব তাঁর পরিবার নিয়ে নড়াইলে তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যান। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি সপরিবারে যশোর ফিরে আসেন। নতুন দেশ, নতুন জীবন। চারিদিকে আনন্দ কিন্তু কোথাও কোন সুখ নাই। জাহানারা হক যশোর থেকে খুলনা অফিস করা শুরু করলেন, রোজ ভোরে আড়াই ঘন্টা বাসে করে অফিসে যান, আড়াই ঘন্টা বাসে করে সন্ধ্যায় ফেরেন। তখন ১৯৭৮ সাল। বড় ছেলে খোকন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছে। এখন যশোর এম এম কলেজের ছাত্র। খরচ বাড়ছে, কমছে না। সব পরিবর্তন হয়েছে। শুধু খন্দকার সাহেবের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় নাই। ৭ বছরে তিনি বিভিন্ন ব্যাবসার চেস্টা করেছেন এবং ব্যার্থ হয়েছেন। প্রতিবার ব্যার্থ হবার পর গ্রামে গিয়ে জমি বিক্রি করেছেন এবং আবার ব্যাবসা করে আবার ব্যার্থ হয়েছেন। ইদানিং জাহানারা হক তাঁর স্বামীকে আর কিছু বলেন না। অফিস থেকে ফিরে নিজে এক কাপ চা বানিয়ে বেগম পত্রিকাটা নিয়ে বাসার সামনের ক্যামেলিয়া গাছের নিচে বসেন। আচ্ছা, বলতে ভুলে গেছি, জাহানারা হক যশোরে এসে খুব খুঁজে আবার একটা ক্যামেলিয়া গাছের চারা এনে লাগিয়েছেন। মানুষ অতীত আঁকড়ে ধরে বাঁচতে ভালোবাসে। যখন অতীতে ফেরার আশা থাকে না, তখন অতীত থেকে ভালোবাসা খুঁজে বর্তমানে এনে সেটাকে আগলে রাখার চেস্টা করে। কেউ মনে হয় ব্যাতিক্রম না।
১৯৮২ সালের ১৩ জুন শাহিন কিটনাশক ওষুধ খেয়ে সুইসাইড করে। শাহিন তখন ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষার্থী। ছেলেটা বাসার কারো সাথে কোনদিন খুব একটা কথা বলতো না। যেদিন শাহিন সুইসাইড করে, সেদিন খন্দকার জহুরুল হক ক্যামেলিয়া গাছটার নিচে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। এই বাসায় খুব পত্রিকার চল আছে। সংসারে টাকা নাই, কিন্তু জ্ঞানের অভাব কোনদিন কেউ অনুভব করে নাই। সুইসাইড করার তিন দিন আগে যশোর জিলা স্টেডিয়ামে ফরিদপুর জেলার সাথে একা ৫ গোল দিয়ে এসে শাহিন তাঁর বাবার হাতে ভয়ংকর মার খেয়েছিল। ২ বারে ম্যাট্রিক পাশ শাহিন মার খেয়ে ক্যামেলিয়া গাছটা জড়িয়ে ধরে হু হু আওয়াজে খুব কেঁদেছিল। সন্ধ্যার দিকে যশোরের এই বাসাটায় বেশ পাখির ডাক শোনা যায়। পাখির ডাকেই হোক কিংবা অনাগ্রহের কারণেই হোক, শাহিনের কান্না বাসার কারো কানে পৌছায় নাই। যাইহোক, খন্দকার সাহেব পত্রিকা পড়ছিলেন তখন শাহিনের বন্ধু বদরুল পাগলের মত কাঁদতে কাঁদতে তাঁর সামনে এসে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলো।
-- চাচা শাহিন নেই চাচা, শাহিন নেই।
আসুন আমরা দেখার চেস্টা করি, ঠিক এই সময় কে কোথায় কি করছিল। শাহিন যখন মারা যায়, খোকন তখন বুয়েটের শেরে বাংলা হলে বসে বি কে মেহতার " পাওয়ার প্ল্যান্ট ম্যানেজমেন্ট " বইটা পড়ছিল। খোকন ১ দিন পর জানতে পারে তাঁর ভাই মারা গেছে। খোকনের স্কুল ফ্রেন্ড লিটন শাহিনের দাফন শেষে ঢাকা রউনা দেয়। লিটন যখন শেরে বাংলা হলের ২১১ নম্বর রুমে খোকনকে শাহিনের মৃত্যু সংবাদ দেয়, খোকন ১২ সেকেন্ড চুপ থেকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। মানুষ বোধ হবার পর থেকেই জানে একদিন তাঁর বাবা মা মারা যাবে। তাকে বাবা মা'র দাফন করতে হবে, তাদের নিয়ে শোকের মাতম করতে হবে, সারা জীবন তাঁদের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। কিন্তু একজন মানুষ কোনদিন ভাবে না যে তাঁর ছোটভাই এর মৃত্যু সংবাদ তাকে শুনতে হবে। মানুষ কল্পনার বাইরের কোনকিছু স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে পারে না। খোকন কোনদিন তাঁর বাবা বা মা'কে শাহিন নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে নাই। কোনদিন জানতে চায় নাই, কেন তাঁর ছোটভাই সুইসাইড করলো। খোকন জানতো যে ভালোবাসা, যে মমতা তাঁর ছোটভাই অনুভব করে নাই, সেই মমতা বা সেই ভালোবাসা তাঁর বাবা মা'র মধ্যে যথেস্ট পরিমানে ছিল। শাহিন জানতো না। কিছু কিছু ছেলে খুব অভিমান নিয়ে জন্মায়। এদের অভিমান আমলে নিতে হয়। এদের অনুভব করাতে হয়। এদের শুধু ভালবাসলেই মনে হয় হয় না। এদের সেই ভালোবাসা জানাতে হয়। শাহিনের জন্য খোকন হাতিরপুল থেকে একটা খয়রী রঙের হাফহাতা শার্ট কিনেছিল। যশোর কারবালা কবরস্থানে শাহিনের কবর জিয়ারত করে বাসায় এসে খোকন সেই শার্টটা ক্যমেলিয়া গাছের সামনের কচুরিপানায় ছুড়ে ফেলে দিল।
জাহানারা হক সন্তানের মৃত্যু সংবাদ পান অফিসে বসে। তিনি কোন কথা বলেন নি। তাঁর কলিগরা একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে তাঁকে যশোর নিয়ে আসেন। জাহানারা হক এক ফোঁটা কাঁদেন নি। শাহিনের শরীর কীটনাশকের বিষে নীল হয়ে গিয়েছে। লাশ বেশ তাড়াতাড়ি দাফন করা হল। জাহানারা হক ছেলেকে দেখার খুব বেশি সুযোগ পেলেন না। জাহানারা হক প্রথম কাঁদলেন শাহিন মারা যাবার দ্বিতীয় দিন। খুব জোরে চিৎকার দিয়ে হাউমাউ করে কান্না। খন্দকার জহুরুল হক তখন বাসার ছাদে বসে একে একে ১৮ নম্বর সিগারেট ধরিয়েছেন। উনি সকাল থেকেই বাচ্চাদের মতো কাঁদছেন। ছেলে মানুষ হবার অনেক সমস্যা আছে। সন্তান মারা গেলেও কাঁদা যায় না। কি যে মুশকিল !
জাহানারা হক খুব একটা শোক পালন করতে পারলেন না কারণ তৃতীয় দিন রাত থেকে তুহিনের মাথায় সমস্যা দেখা দিল। ছোট্ট তুহিনের বয়স এখন ১৫ বছর। সে আর ছোট্ট নেই। তৃতীয় দিন রাতে তুহিন পড়ার টেবিলে শাহিন কে দেখতে পেল। শাহিন খুব সাধারণ ভাবে দাঁত ব্রাশ হাতে তুহিন কে বলল, " বুড়ি পেস্ট দে তো। " তুহিন জাহানারা হকের কাছে এসে বলল, " মা, ছোট ভায়া পেস্ট চায়, পেস্ট কই? " জাহানারা হক কিছুক্ষন তুহিনের দিকে তাকিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।
তুহিনের স্বাভাবিক হতে ২ বছর সময় লেগেছিল। ১৯৮৬ সালের ১১ তম বি সি এস পরীক্ষায় খোকন গনপুর্ত অধিদপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে নিয়োগ পান। এক ডাক পিয়ন একদিন ভোরে খোকনের নিয়োগপত্র নিয়ে হাজির হয়। হলুদ খামের উপর বড় বড় করে লিখা, " ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার কবির হক "। খন্দকার জহুরুল হক আনন্দে পিয়নকে ১০০ টাকা বকশিশ দিলেন। ১৯৮৬ সালে ১০০ টাকা মানে অনেক টাকা। জাহানারা হক তখন অফিসে। খোকন খবরটা পেয়ে বাবাকে সালাম করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। কেউ খন্দকার সাহেবকে বলে নাই কিন্তু উনি জানতেন খোকন কারবালা কবরস্থানে গেছে।
১৯৮৯ সালে খোকন বিয়ে করে। পাত্রী নাসিমা বেগম, ডাকনাম রুমি। মেয়ের বাড়ি সিলেটের মৌলভীবাজার। বিয়ের কার্ডে বড় করে লিখা ছিল, " Engineer Khandker Kabir Hoque weds Nasima Begum "
বিয়ের পর নাসিমা বেগম যশোর আসলেন। নতুন বৌ। নাসিমা বেগম খুব অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে ছিলেন। যশোরের এই ইটের মেঝে আর বৈঠকখানার বাইরের বাথরুমের সাথে তাঁর আগে পরিচয় ছিল না। নাসিমা বেগমের কস্ট হল, বেশ কস্ট হল। কিন্তু তিনি মানিয়ে নিলেন। তুহিনের বিয়ে হয়ে গেছে এক মৎস্য কর্মকর্তার সাথে। ঘরে সারাদিন খন্দকার সাহেব আর তাঁর বৌমা। নতুন বৌমাকে তাঁর নিজের মেয়ের চেয়ে বেশি কাছের মনে হয়। জাহানারা হক সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন। আচ্ছা দাঁড়ান, আমরা খোকন কে এখন আর খোকন বলে ডাকবো না। একজন প্রথম শ্রেণীর সরকারী অফিসারকে নাম ধরে ডাকাটা ঠিক সমিচিন নয়। কবির সাহেব আর নাসিমা বেগমের প্রথম সন্তান রাশেদের জন্ম ১৯৯১ সালের ১২ ডিসেম্বারে। সেদিন যশোরে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল। সেদিন খন্দকার সাহেব শাহিনের কবরের সামনে গিয়ে একা একা হাউমাউ করে অনেকক্ষন কান্নাকাটি করলেন। ভালোবাসা খুব অদ্ভুত জিনিস। কিছু মানুষ সারা জীবন ভালোবাসা লুকায়ে রাখতে ভালোবাসে। ভয়ে, পাছে এই বুঝি ভালোবাসা দুম করে উড়ে যায় !
ছোট্ট রাশেদ দাদা দাদীর খুব ন্যাওটা হল। খন্দকার সাহেব রাশেদকে ছেড়ে এক মুহুর্ত থাকতে পারেন না। রোজ সকালে রাশেদ খন্দকার সাহেবের সাথে পুকুর পাড়ে মাছ ধরতে বসে। দাদুভাই আর নাতি ছিপ ফেলে বসে থাকে। রাশেদ খুব দুরন্ত, বড়শিতে টান পড়লেই উঠে লাফানো শুরু করে। সেই লাফালাফি দেখে খন্দকার সাহেবের বুক ভরে যায়। তিনি অনাবিল আনন্দ পান। বিকালে রাশেদ তার দাদুভায়ের সাথে ক্যামেলিয়া গাছের নিচে ফুটবল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে। সন্ধ্যায় জাহানারা হক অফিস থেকে ফিরে রাশেদ কে কোলে নিয়ে গল্প শুনাতে বসেন। ৪ বছর বয়স হবার আগে রাশেদের রামায়ন মহাভারত, ইলিয়ড ওডিসি, ঠাকুমার ঝুলি সব শোনা হয়ে গেলো। দাদা দাদীর জীবনে রাশেদ ছাড়া কেউ নাই। আজকে এটা কালকে ওটা কিনে আনা হয়। রাশেদের জ্বর, রাশেদের স্কুল, রাশেদের দুস্টুমি ... পুরো বাড়ি শুধু রাশেদ আর রাশেদ...
১৯৯৭ সালে কবির সাহেব চেস্টা তদবির করে ঢাকায় বদলি হয়ে এলেন। জাহানারা হক আগের বছর অবসর নিয়েছেন। বদলির খবর শুনে জাহানারা হক হতভম্ব হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। খন্দকার সাহেব ছেলেকে বললেন,
-- খোকন, তুমি আবার ভেবে দেখো বাবা, ঢাকা যাওয়ার কি দরকার, তোমরা তো এখানে ভালো আছ।
-- আব্বা, জীবনে তো বড় হতে হবে। এখানে ভালো স্কুল নাই, কোন কিছুর ভালো ব্যাবস্থা নাই, রাশেদ বড় হচ্ছে, ওর তো একটা ভালো গাইডেন্স দরকার, আমি এখানে পড়াশুনা করছি, আমার ছেলেকে তো ভালো জায়গায় পড়াশুনা করানো আমার দায়িত্ব...
রাশেদ খুব খুশি। সে ঢাকা যাচ্ছে। একটা মস্ত ট্রাক এসেছে। ট্রাকে সোফা, খাট, শোকেস এসব তোলা হচ্ছে। রাশেদ একটা খেলনার প্লেন নিয়ে ক্যামেলিয়া গাছটার নিচে দৌড়চ্ছে আর বলছে, " আমি ঢাকা যাচ্ছি ভোঁ ভোঁ , ভোঁ ভোঁ ... "
স্টেশানে ট্রেন ছাড়ার সময় রাশেদ টের পেলো তাঁর দাদা দাদী কেউ তাঁদের সাথে যাচ্ছে না। রাশেদ টের পাওয়া মাত্রই তাঁর দাদার গলা শক্ত করে ধরে কোলে উঠে বসে থাকলো। ট্রেন ছাড়ার সময় রাশেদের মা নাসিমা বেগম রাশেদ কে তাঁর শ্বশুরের কোল থেকে নিয়ে নিলেন। রাশেদের সে কি কান্না ! ট্রেন চলে গেলো। খন্দকার জহুরুল হক বাড়ি ফিরে এলেন। সেদিন যশোরে ভয়ংকর বৃষ্টি হল। সেই বৃষ্টিতে নবগংগা নদীর বাঁধ, টাউন হল ময়দানের সামনের গফুরের চা দোকানের চাল আর খন্দকার সাহেবের বাড়ির উঠোনের ক্যমেলিয়া গাছের সব ফুল ঝরে ভেসে চলে গেলো। রিকশায় খন্দকার সাহেবের আর ফুল গাছের তলায় জাহানারা হকের কান্নাও বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে মুছে ভেসে চলে গেলো।
২০০০ সালে কবির সাহেব আর নাসিমা বেগমের দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হল। ফুটফুটে একটা মেয়ে। মেয়ের ফুপু তুহিন মেয়ের নাম রাখলেন রাইদা। রাইদার দাদা দাদী ফুপু সবাই ঢাকা এলেন। ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় কবির সাহেবের সরকারী কোয়ার্টার। রাশেদ দেশের সবচেয়ে নামকরা স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ইদানিং রশেদ খুব লজ্জা পাওয়া শিখেছে। দাদা দাদীর সাথে আগের মত কথা বলে না। যে যাই বলে, সে খুব লজ্জা পায়। রাইদার জন্মে চারিদিক খুশিতে ভরে গেলো। চারিদিকে আনন্দ, উৎসব উৎসব একটা ভাব।
২০০২ সালে জহুরুল হকের ক্যান্সার ধরা পড়লো। ভদ্রলোক ৮ বছর বয়স থেকে সিগারেট খান। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর দেখা গেলো সেটা শেষ পর্যায়। কবির সাহেব সৎ অফিসার। নিজের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে বক্ষ্যব্যাধি হাসপাতালে বাবার চিকিৎসা করাচ্ছেন। প্রতিদিন খন্দকার সাহেবের বৌমা তাঁর দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে বিকাল বেলা হাসপাতালে আসেন। রাইদা তাঁর দাদুভাইয়ের বিছানায় গড়াগড়ি দেয়, সে নতুন দাদু বলা শিখেছে। রাশেদ চুপ করে বসে থাকে। তাঁর খুব কস্ট হয় তাঁর দাদুভাইয়ের জন্য। একটা নল বুকের সাথে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে একটু পর পর বুক থেকে পানি এসে জমা হয়। রাশেদ কস্ট পায় কিন্তু কিছু বলে না। একদিন বিকালে কেবিনে কেউ নেই, খন্দকার সাহেব তাঁর বৌমা কে ডেকে বললেন,
-- আমারে আমার ছেলেটার পাশে কবর দিও বৌমা, ছেলেটা খুব অভিমান নিয়ে মরলো, আমারে খুব ভুল বুঝে মরছে, আমি দেখি চেস্টা করে ওর ভুল ভাংতে পারি নাকি।
-- আব্বা এসব ভাববেন না। ডাক্তার দেখুক, আরও যা যা করা লাগে রাশেদের আব্বু করবে। আপনি ঘুমান।
খন্দকার সাহেব ঘুমালেন এবং আর উঠলেন না।
খন্দকার সাহেবকে শাহিনের ঠিক পাশে দাফন করা হল। কেউ জানলো না কিন্তু খুলনার ইকবাল নগরের একটা বাসার উঠোনের ক্যামেলিয়া গাছে সেদিন ফুলের গন্ধে সারা বাড়ি মৌ মৌ করে উঠেছিল।
স্বামীর মৃত্যুর পর জাহানারা হক ঢাকা এসে তাঁর ছেলের বাড়িতে উঠলেন। তিনি জিদ করে ২ বছর একা যশোরে ছিলেন। কবির সাহেব, রাশেদ, রাইদা এবং নাসিমা বেগম তাঁকে বহু বুঝিয়েও ঢাকা আনতে পারেনি। কিন্তু একসময় তাঁর ভয় করতে শুরু করলো। তাঁর কথা বলার কেউ নেই। রোজ বিকেলে তিনি ক্যামেলিয়া গাছের সাথে একা একা কথা বলেন। তিনি কথা বলেন, কিন্তু কারো কথা তো শুনতে পান না। এক দুপুরে জাহানারা হক তাঁর ছেলেকে ফোন দিয়ে বললেন, " খোকন আমারে ঢাকা নিয়ে যাও। "
নটরডেম কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করে ২০১১ সালে রাশেদ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে কুয়েট ভর্তি হয়। এক সন্ধ্যায় খুলনার ইকবালনগরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ক্যামেলিয়া ফুলের গন্ধ পেয়ে রাশেদ একটা বাসার উঠোনে ঢুকে পড়লো। এই গন্ধ তাঁর খুব পরিচিত, এই গন্ধ তাঁর শৈশবের গন্ধ, তাঁর আত্মার গাঁথুনির গন্ধ। রাশেদ কে দেখে বাসা থেকে এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রমহিলা বের হয়ে আসলেন।
-- কাউরে খুজতিসো বাপ?
রাশেদ কি বলবে বুঝতে না পেরে গেট দিয়ে বের হয়ে গেলো।
২০১৪ সালের এক বিকেলে জাহানারা হক তাঁর ছেলেকে ডেকে বললেন,
-- খোকন, আমাদের যশোরের বাড়ির চারিদিকে একটা দেয়াল দেয়া দরকার। তুমি একটা দেয়াল দাও। ভাড়াটিয়ারা বলতিসে আশেপাশের মানুষজন জায়গা দখল করার মতলব করতিসে।
-- মা, দেয়াল দিতে লাখ খানেক টাকা দরকার। আমার কাছে এখন অত টাকা নেই। আমি গত মাসে বেইলি রোডে একটা ফ্ল্যাট বুক করসি।
জাহানারা হক কিছুক্ষন ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-- ঐটা নিজের বাড়ি তোমার। ঐটার একটু খিয়াল রাখবা না বাবা?
-- মা ঐ বাড়িতে কে থাকবে বলেন? আপনার বৌমা সংসারের টাকা জমায় জমায় একটা একাউন্টে রাখসিল, নিজের একটা ফ্ল্যাট হবে ঢাকায় এইটা তাঁর বহুদিনের ইচ্ছা। রাশেদ বা রাইদা তো যশোর গিয়ে কোনদিন থাকবে না মা, আপনি তো বোঝেনই ...
জাহানারা হক নিজের ঘরে ফেরত এলেন। ঘরে প্রচণ্ড ঠান্ডা। তাঁর ছেলে মায়ের জন্য ঘরে এসি লাগিয়ে দিয়েছে। জাহানারা হক খাটের কে কোনায় চুপ করে বসে রইলেন। পাশেই রাইদা জোরে জোরে পড়ছে, " কোষে নিউক্লিয়াসের পাশাপাশি সাইটোপ্লাজম, কোষ ঝিল্লি এবং ক্রমোজম থাকে ... "
২০১৭ সালে কবির সাহেব তাঁদের বেইলি রোডের ফ্ল্যাটে উঠলেন। নাসিমা বেগম ৫২ বছর বয়সে নিজের একটা বাসা পেলেন। বাসার ছাদে মাটি দিয়ে উঁচু করে একটা নার্সারি বানানো হয়েছে। এখানে পুরো বিল্ডিং এর বিভিন্ন মানুষ গাছ লাগিয়েছে। নাসিমা বেগম রাইদাকে নিয়ে আসার সময় ভিকারুন্নেসা কলেজের সামনে থেকে একটা ক্যামেলিয়া গাছের চারা কিনলেন। সেদিন বিকালে খুব শখ করে নাসিমা বেগম ছাদের বাগানে গাছটা লাগালেন। দূর থেকে জাহানারা হক সেটা দেখলেন, কিছু বললেন না।
২০১৮ সালের এক সন্ধ্যায় রাশেদ বাসায় জানালো তাঁর মিনেসোটা ইউনিভার্সিটিতে স্ট্র্যাকচালার ইঞ্জিনিয়ারিং এ মাস্টার্সে স্কলারশিপ সহ এডমিশান হয়েছে। নাসিমা বেগম খবরটা শুনে রান্না ঘরে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কবির সাহেব কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। রাশেদ কে ডেকে বললেন,
-- তুমি এখানেই সেটেল করো। বাইরে তো ঝামেলা। এখানে তো ভালোই আছ। বি সি এস দাও, নাহলে একটা ভালো চাকরী করো। আস্তে ধীরে নিজের একটা কোম্পানি দাও...
-- দেখো আব্বা, জীবনে তো বড় হতে হবে। তুমি যশোরে বড় হইসো, এরপর আমাকে নিয়ে ঢাকা আসছ। লাইফটাকে বেটার করার ট্রাই করসো। আমি যদি ঢাকায় বড় হয়ে এখানেই থেকে যাই, আমি তাহলে আসলে কি করলাম? আমাকেও তো আগাতে হবে তাই না? এই দেশে আমার মুল্যায়ন হচ্ছে না। আমার ইউ এস এ শিফট করা উচিৎ। আমি আগেই ডিসিশান নিয়ে রাখসি। তুমি তো বুঝোই, আম্মা না বুঝলেও তুমি তো আমার পয়েন্টটা বুঝতেসো আমি জানি।
২০২৫ সালের ১৩ জুন। আজ শাহিনের ৪৩ তম মৃত্যুবার্ষিকী। আজ ঢাকার আকাশে প্রচন্ড মেঘ। যশোরের টাউনহল ময়দানে আজ জেমস এর কনসার্ট। ১৭ বছর পর জেমস যশোর এসেছেন। ঠিক এই সময় সাড়ে আট হাজার মাইল দূরে ক্রিস্টিনা তাঁর মেয়ে অধরা'র হাত ধরে তাঁদের নিউ জার্সির বাসার উঠোনে হাটাহাটি করছিল। উঠোনের শেষ মাথায় একটা ক্যামেলিয়া ফুলের গাছ।
ঠিক সন্ধ্যা ৭ টায় জেমস টাউনহল মাঠে গান গাইতে উঠলেন।
ঠিক সন্ধ্যা ৭ টায় ৮৫ বছর বয়সী জাহানারা হক তাঁর ছেলের ১৮ তলার ফ্ল্যাটের জানালার পাশের চেয়ারে এসে বসলেন।
ঠিক সন্ধ্যা ৭ টায় নাসিমা বেগম বাসার ছাদে উঠে তাঁর ক্যামেলিয়া গাছটার পাশে চুপ করে দাঁড়ালেন।
ঠিক সন্ধ্যা ৭ টায় খুলনার ইকবাল নগরের একটা বাসার উঠোনে একটা মুমূর্ষু ক্যামেলিয়া গাছ শেষ বারের মতো কিছু অক্সিজেন ছাড়ার চেস্টা করলো।
ঠিক সন্ধ্যা ৭ টায় কবির সাহেব ইজি চেয়ারে বসে ড্রয়ার থেকে শাহিনের ছবিটা বের করে বসলেন।
ঠিক ঐ সময়ে নিউ জার্সিতে প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হল। সেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে ক্রিস্টিনা দেখতে পেলো তাঁদের ক্যামেলিয়া গাছটায় প্রথমবারের মত ফুল ফুটেছে। আহা কি সুগন্ধ ! আহা কি আনন্দ ক্রিস্টিনার !
ক্রিস্টিনা যখন তাঁর স্বামী রাশেদকে স্টাডি রুম থেকে ডেকে ক্যামেলিয়া ফুলটা দেখাচ্ছিল, তখন অধরা সেই গাছের চারিদিকে একটা খেলনার প্লেন হাতে নিয়ে, " I'm dady's princess, I'm dady's princess " বলে দৌড়চ্ছিল।
ঠিক সেই সময় খুলনা, যশোর, ঢাকা আর নিউ জার্সিতে তুমুল শব্দে বৃষ্টি নেমে এলো। সেই বৃষ্টিতে বাদল দিনের প্রথম কদম ফুলের মত নাসিমা বেগমের ক্যামেলিয়া গাছ থেকে একটা ক্যামেলিয়া ফুল মাটিতে ঝরে পড়লো। ঠিক সেই সময়ে যশোরের উঠোনের ক্যামেলিয়া গাছটা থেকে সবগুলো ফুল এক রাশ মাতাল গন্ধ ছড়িয়ে ঝরে ঝরে পড়তে লাগলো। ঠিক সেই বৃষ্টিতে খুলনার ইকবালনগরের বহু পুরানো একটা ক্যামেলিয়া গাছ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো।
ঠিক সেই সময় শাহিনকে পাশ থেকে খন্দকার জহুরুল হক জড়িয়ে ধরে বললেন, " শাহিন বাপ আমার, ভয় পাস না, আমি আছি, এই ঝড়ে তোর কিছু হবে না। আমি তো আছি। আয় বাপ আমার কাছে আয়। "
ঠিক সেই সময় জেমস কারবালা কবরস্থান থেকে আড়াই মাইল, ঢাকা থেকে আড়াইশো মাইল আর নিউ জার্সি থেকে সাড়ে আট হাজার মাইল দূরে গেয়ে উঠলেন,
" ফুল শুধু ছড়াবে সৌরভ, লজ্জায় বলবে না কিছুই, ফুল থাকবে নীরব... "
     
 
what is notes.io
 

Notes.io is a web-based application for taking notes. You can take your notes and share with others people. If you like taking long notes, notes.io is designed for you. To date, over 8,000,000,000 notes created and continuing...

With notes.io;

  • * You can take a note from anywhere and any device with internet connection.
  • * You can share the notes in social platforms (YouTube, Facebook, Twitter, instagram etc.).
  • * You can quickly share your contents without website, blog and e-mail.
  • * You don't need to create any Account to share a note. As you wish you can use quick, easy and best shortened notes with sms, websites, e-mail, or messaging services (WhatsApp, iMessage, Telegram, Signal).
  • * Notes.io has fabulous infrastructure design for a short link and allows you to share the note as an easy and understandable link.

Fast: Notes.io is built for speed and performance. You can take a notes quickly and browse your archive.

Easy: Notes.io doesn’t require installation. Just write and share note!

Short: Notes.io’s url just 8 character. You’ll get shorten link of your note when you want to share. (Ex: notes.io/q )

Free: Notes.io works for 12 years and has been free since the day it was started.


You immediately create your first note and start sharing with the ones you wish. If you want to contact us, you can use the following communication channels;


Email: [email protected]

Twitter: http://twitter.com/notesio

Instagram: http://instagram.com/notes.io

Facebook: http://facebook.com/notesio



Regards;
Notes.io Team

     
 
Shortened Note Link
 
 
Looding Image
 
     
 
Long File
 
 

For written notes was greater than 18KB Unable to shorten.

To be smaller than 18KB, please organize your notes, or sign in.